জলবায়ু পরিবর্তন

জলবায়ু পরিবর্তন : সবুজ শ্যামল দেশ বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর অন্যতম হলো বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও নদী বিধৌত ব-দ্বীপ বাংলাদেশ আরও প্রাকৃতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। বর্তমানে সব থেকে আলোচিত বিষয় হলো জলবায়ু পরিবর্তন।

আগে আমরা জানতাম জলবায়ু পরিবর্তন হলো ৫০-৬০ বছরের সামগ্রিক আবহাওয়ার পরিবর্তন। কিন্তু বর্তমানে, বিগত ৪-৫ বছরের জলবায়ুর আচরন দেখলে দেখা যাবে সেটি খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। আর যার প্রভাব পরছে বাংলাদেশের মতো স্বল্প উন্নত দেশের উপর। আর এই প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ।

বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, নদী ভাঙন, জলাবদ্ধতা ও পানি বৃদ্ধি এবং মাটির লবণাক্ততা ইত্যাদি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার সবথেকে বড় শিকার হলো আমাদের দেশের শিশু,নারী এবং বৃদ্ধ।

এখন আসি ,আমাদের এই জলবায়ু কেন পরিবর্তন হচ্ছে?

জলবায়ু পরিবর্তনের সবথেকে বড় কারন হলো কার্বন নিঃসরন। উন্নত বিশ্বের কার্বন নিঃসরন আমাদের মতো সমুদ্রতীরবর্তী দেশগুলোর বড় ক্ষতির কারন। শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই যে হারে কার্বন নিঃসরন বেড়েছে,তার ফল এই স্বল্প সময়ের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন।বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্র গুলোই এইসব কার্বন পরিবেশে ছরাচ্ছে।বিশ্বের কিছু দেশের চিত্র দেখে নেই।

1.Chaina

  • কার্বন নিঃসরন এর দিক থেকে চায়না বিশ্বে প্রথম।
  • চায়না প্রায় ১০.০৬ বিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন পরিবেশে ছরায়।
  • চায়নার মোট উৎপাদিত শক্তির ৫৪% আসে কয়লা ও জীবাষ্ম জ্বালানী পুড়িয়ে, যা পরিবেশে প্রচুর কার্বন নিঃসরন করে।

জলবায়ু পরিবর্তন

2.America

  • আমেরিকা হলো দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরনকারী দেশ।
  • তারা প্রতিবছর ৫.৪১ বিলিয়ন মেট্রিকটন কার্বন পরিবেশে ছরায়।
  • আমেরিকা তাদের শক্তির বেশিরভাগ ই জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে পায়।
  • যা থেকে প্রচুর পরিমানে কার্বন বাতাসে ছরায়।উল্লেখ্য ২০০৬ সালে আমেরিকা কার্বন নিঃসরনে বিশ্বের এক নম্বর স্থানে ছিল।

3.India

  • তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইন্ডিয়া।
  • ইন্ডিয়া প্রতি বছর প্রায় ২.৬৫ মিলিয়ন কার্বন নিঃসরন করে।
  • ইন্ডিয়া মারাত্বক ভাবে কয়লা,প্রাকৃতিক তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভরশীল।
  • ইন্ডিয়া তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনেও কয়লার উপর নির্ভরশীল।
  • ১৯৯২ সালে ইন্ডিয়ার কয়লা নির্ভর বিদুৎ উৎপাদন ছিল ৬৮%,যা ২০১৫ সালে এসে দাড়িয়েছে ৭৫% এ।

4.The Russian Federation

  • প্রতিবছর গড়ে ১.৭১ বিলিয়ন মেট্রিকটন টন কার্বন পরিবেশে ছরায় রাশিয়া।
  • রাশিয়া সবথেকে বড় প্রাকৃতিক গ্যাস নির্ভর অর্থনীতির দেশ।
  • এছারাও রাশিয়া জীবাশ্ম জ্বালানির উপর বেশ নির্ভরশীল।

5.Japan

  • বিশ্বে গড়ে ১.৬১ মিলিয়ন মেট্রিকটন কার্বন ডাই অক্সাইড পরিবেশে ত্যাগ করে জাপান।
  • 2011 সালে ফুকুশিমা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট বন্ধের পথ এই দেশটি জীবাশ্ম জ্বালানির দিকে বেশি ঝুকেছে।
  • তবে তাদের উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তি আশার আলো দেখাচ্ছে।

[২০১৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, https://www.investopedia.com/]

তো আমরা দেখতে পাচ্ছি কি পরিমান কার্বন পরিবেশে ছরায়। আর এর দায় উন্নত বিশ্বের।

জলবায়ু পরিবর্তন

  • জলবায়ু পরিবর্তন এর অন্যতম কারন হলো গাছ কাটা।
  • প্রতিবছর হাজার হাজার গাছ জ্বালানির জন্য কাটা হচ্ছে।
  • গাছ সাধারন আমাদের পরিবেশের অতিরিক্ত কার্বন শোষন করে এবং সালোকসংশ্লেষন এর মাধ্যমে খাদ্য তৈরী করে। কিন্তু গাছ কাটার ফলে এই কার্বন শোষনের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
  • প্রতিবছর প্রায় 12.2 মিলিয়ন হেক্টর জমির গাছ কাটা হচ্ছে।

আমাদের ট্রপিকাল রেইনফরেস্ট ৩১% কভার করে রাখে পৃথিবীকে।আমাজন কে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। অথচ এই সকল যায়গার গাছ কর্তন করা হচ্ছে, দাবানলের ফলে গাছ পুড়ে যাচ্ছে।FAO এর রিপোর্ট মতে, গত ৫ বছরে নাইজেরিয়ায় এবং ব্রাজিলে সবথেকে বেশি গাছ কাটা হয়েছে। এইসব কৃত্রিম পরিবর্তনের জন্য জলবায়ুর উপর মারাত্মক প্রভাব পরছে।বর্তমানে বিশ্বে ৩ ট্রিলিয়ন গাছ রয়েছে যার অর্ধেক রয়েছে ট্রপিকাল অঞ্চলে। কিন্তু এই গাছ ও কয়দিন টিকবে তা প্রশ্নবিদ্ধ। ২০২০ সালের আমাজন ট্রাজেডি তে ৪৩০০০ হেক্টর জমির গাছ(১৭০০০ মাইল) পুড়ে গেছে। গত ৩০ বছরে ১৫% গাছ পুড়ে গেছে আমাজন বনের। এছারাও অস্ট্রেলিয়ার বুশ ফায়ারের কথা তো আমরা সবাই ই জানি। ২০১৯ সালে, ৭৯ দিন টানা দাবানলের ফলে ১৯১,০০০ হেক্টর জমির গাছ পুড়ে গেছে। আর এর থেকে ৪৩৪ মিলিয়ন কার্বন ডাই অক্সাইড পরিবেশে ছরিয়েছে।
তাহলে বোঝাই যাচ্ছে বর্তমানে বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন কেন হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমস্যা গুলি কি?

জলবায়ুর জন্য সৃষ্ট সমস্যা আমাদের সকলের কাছেই দৃশ্যমান।বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আলোচনা করি।
বিগত ৫/৬ বছর যাবৎ যেহারে বন্যা, ঝড়, জ্বলোচ্ছাস হচ্ছে তাতে তা স্পষ্ট যে জলবায়ু কতটা পরিবর্তন হচ্ছে। আগে দেখা যেত ২/৩ বছর পর পর কোনো এলাকায় স্বাভাবিক বন্যা বা ঝড় হত।কিন্তু ইদানীং খুব বড় বড় ঘুর্নিঝড় হচ্ছে যাতে হাজার হাজার লোক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছারাও আমাদের ঋতু বৈচিত্রেও পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো ছয়টি ঋতু কখনোই দেখা যায় না। এখন তিনটি ঋতু দেখা যাচ্ছে-গ্রীষ্ম,বর্ষা,শীত।তাও গ্রীষ্মকাল দীর্ঘ হচ্ছে আর বর্ষা আর শীত দেরিতে আসছে,স্থায়িত্ব ও কম। আবার অনিয়মিত বৃষ্টিপাত হচ্ছে যার ফলে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন

গরমের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। গত ২৫ এপ্রিল দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বৃদ্ধির রেকর্ড রয়েছে,তা হলো ৪২.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যা বিগত ২ যুগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে কি হারে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। এবং আমাদের দেশ মরুকরনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠর উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছারাও অত্যধিক গরমে সমুদ্রপৃষ্ঠের আয়তন বৃদ্ধি হচ্ছে ফলে পানির আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলের বেশির ভাগ জেলা প্লাবিত হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে।বাংলাদেশ সহ আরো সমুদ্র তীরবর্তী দেশ গুলোও ঝুকিতে রয়েছে। নদীভাঙ্গন বৃদ্ধি পাচ্ছে।ফলে গৃহহারা হচ্ছে অনেক মানুষ। ফলে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনসংখ্যা ঘনত্ব বেড়ে যাচ্ছে‌।এছারাও বাল্যবিবাহ,সামাজিক নিরাপত্তার অভাব,বস্তি অঞ্চলের সৃষ্টি,কর্মসংস্থানের অভাব ইত্যাদি সামাজিক সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন সকল সমস্যার লুকায়িত কারন।

আরো পড়ুন: মধ্যবিত্ত – নুর আতিকুন নেছা
আরো পড়ুন: paragraph: Plysical Exercise(বাংলা অর্থসহ)

এখন বলতে পারি আমাদের দেশের বাল্যবিবাহ, নিরাপত্তাহীনতা আর দারিদ্র্যতা কিভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হতে পারে। উত্তর টা খুব সহজ। ধরা যাক কোনো এলাকায় একটা পরিবার নদীভাঙ্গন এর শিকার হলো। যে পরিবারে একটা কন্যা শিশু রয়েছে।নদীভাঙ্গনের পর যখন তারা অন্যত্র চলে যাবেন তখন সেখানে জনসংখ্যা একটু হলেও বাড়বে এবং ঘনত্ব বেড়ে যাবে। এরপর নতুন পরিবেশ কাজের অভাব দেখা দিবে এটাই স্বাভাবিক। হঠাৎ কেউ তো আর কাজ পায় না। আর মানিয়ে নিতেও টাইম লাগে।দেখা দিচ্ছে এখানে দারিদ্রতা।এরপর নতুন পরিবেশে অপরিচিত লোকজন, বাসস্থান এর অভাব।ফলে স্বভাবত ই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন।ফলে ঘরে থাকা কন্যা শিশুর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হবেন বাবা-মা।ফলে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে মেয়ের থাকার যায়গা নিশ্চিত করতে চাইবেন। ফলে বাল্যবিবাহ হার বেড়ে যাবে।

জলবায়ু পরিবর্তন

এভাবেই একেকটা সামাজিক সমস্যার পেছনের কারনটা জলবায়ু পরিবর্তন। [এখানে একটি পরিবারের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু নদীভাঙ্গনে হাজার হাজার লোক গৃহ হারা হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়।তাই সবকিছুর বৃদ্ধির হার বেরে যায়।]

জলবায়ু পরিবর্তনের এই সমস্যা সমাধানে আমাদের কাছে কি কোনো করনীয় আছে? সমাধান কি?

সকল সমস্যার সমাধান থাকবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে এর ও সমাধান আছে। কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদী। সবার আগে উন্নত বিশ্বের নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের অর্থনীতি শক্ত করার জন্য যে হারে কার্বন নিঃসরনে করে তা কমাতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির উপর থেকে নির্ভরশীল হওয়া যাবে না।আমাদের ভিতর সচেতনতা আনতে হবে। প্রতিবছর COP (conference of the parties) আয়োজন করা হয়। নেতাদের প্রতি একটাই অনুরোধ তারা যেন সম্মিলিত ভাবে সমস্যার সমাধানে আসে।

আরো পড়ুন: এলাচের অবিশ্বাস্য উপকারিতা
আরো পড়ুন: ‘মা হারা সন্তান’ – নুর আতিকুন নেছা

জলবায়ু পরিবর্তন

প্যারিস চুক্তির মতো কার্যকরী আরো কিছু চুক্তি হওয়া প্রয়োজন। আর বাংলাদেশ এ মানুষদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। যুবকদের সক্রিয়তা বাড়াতে হবে। তাদের সুযোগ তেরী করে দিতে হবে। সরকারী ভাবে লোকদেরকে এই বিষয়ে ট্রেনিং এর আয়োজন করা যেতে পারে। ভিশন ২১, ভিশন ৪১, ভিশন ২১০০ এর মতো প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে হলে জলবায়ুর পরিবর্তন গুলোকে আগে সামলাতে হবে। আর বিশ্ব নেতাদের আগে এগিয়ে আসতে হবে,তাদের আগে সচেতন হতে হবে। আর নাহলে কোনো কিছুই কাছে আসবে না। মনে রাখতে হবে, এই পৃথিবী সবার,কারো একার বাবার সম্পত্তি নয়। তাই সকলকেই একসাথে কাজ করতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে নজর দিতে হবে। নাহলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে থাকবো।

নাম: মুহাম্মাদ মুনেম শাহরিয়ার
শ্রেনি: একাদশ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ

আরো পড়ুন: ৯ম-১০ম শ্রেণি: বাংলা-২য় পত্র ১ম অধ্যায়ের MCQ উত্তরসহ
আরো পড়ুন: বিখ্যাত আবিষ্কার ও আবিষ্কারকের নাম

যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন।

Leave a Comment