আবুল কাশেম ফজলুল হক জীবনী

আবুল কাশেম ফজলুল হক (উর্দু: ابو القاسم فضل الحق‎‎, ২৬ অক্টোবর ১৮৭৩-২৭ এপ্রিল ১৯৬২) বাঙালি আইনজীবী, লেখক এবং সংসদ সদস্য ছিলেন।

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি কূটনীতিক হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের নিকট শেরে বাংলা[৩] এবং ‘হক সাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন।

তিনি রাজনৈতিক অনেক পদে অধিষ্ঠান করেছেন, তার মধ্যে কলকাতার মেয়র (১৯৩৫), অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী (১৯৩৭-১৯৪৩),

পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী (১৯৫৪), পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৫৫), পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর (১৯৫৬-১৯৫৮) অন্যতম। যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।

শেরে বাংলা, আবুল কাশেম ফজলুল হক
A k fazlul hoque.jpg
আবুল কাশেম ফজলুল হক
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর
কাজের মেয়াদ ১৯৫৬ – ১৯৫৬
রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মীর্জা
উত্তরসূরী সুলতানউদ্দিন আহমেদ
পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী: কাজের মেয়াদ ১৯৫৪ – ১৯৫৫
গভর্নর-জেনারেল মালিক গোলাম মুহাম্মদ
ইস্কান্দার মীর্জা
উত্তরসূরী আবু হোসেন সরকার
বাংলার প্রধানমন্ত্রী
কাজের মেয়াদ
১ এপ্রিল ১৯৩৭ – ২৯ মার্চ ১৯৪৩
গভর্নর-জেনারেল লর্ড লিনলিথগো
গভর্নর জন আর্থা‌র হার্বা‌র্ট‌
পূর্বসূরী নতুন পদ
উত্তরসূরী খাজা নাজিমুদ্দিন
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্ম: আবুল কাশেম ফজলুল হক
২৬ অক্টোবর ১৮৭৩
বাকেরগঞ্জ, ব্রিটিশ ভারত
(বর্তমান বরিশাল জেলা, বাংলাদেশ)
মৃত্যু ২৭ এপ্রিল ১৯৬২ (বয়স ৮৮)
ঢাকা, পূর্ব পাকিস্তান, পাকিস্তান
(বর্তমান ঢাকা, বাংলাদেশ)
সমাধিস্থল তিন নেতার মাজার
নাগরিকত্ব ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত)
পাকিস্তান (১৯৫৬–১৯৬২)
(বর্তমান বাংলাদেশ)
রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস
নিখিল ভারত মুসলিম লীগ
কৃষক প্রজা পার্টি
কৃষক শ্রমিক পার্টি
দাম্পত্য সঙ্গী খুরশিদ বেগম
জান্নাতুন্নিসা বেগম খাদিজা
সন্তান এ. কে. ফয়জুল হক
প্রাক্তন শিক্ষার্থী: বরিশাল জিলা স্কুল
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
ধর্ম: ইসলাম
ডাকনাম শের-এ-বাংলা (বাংলার বাঘ)

প্রারম্ভিক জীবন:

মূল নিবন্ধ: এ.কে.এম. ফজলুল হকের জন্মস্থান:

এ. কে. ফজলুল হক ১৮৭৩ সালে ২৬ অক্টোবর বরিশাল জেলার রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার আদি পৈতৃক নিবাস পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলায়। তিনি কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ এবং সাইদুন্নেসা খাতুনের এক মাত্র পুত্র ছিলেন।

এ. কে. ফজলুল হকের প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতেই শুরু হয়। পরে তিনি গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হয়ে ছিলেন। গৃহ শিক্ষকদের কাছে তিনি আরবি, ফার্সি এবং বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করেন।

১৮৮১ সালে তিনি বরিশাল জিলা স্কুলে ৩য় শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা করেন। ১৮৮৬ সালে ৮ম শ্রেণিতে তিনি বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৮৯ সালে ফজলুল হক প্রবেশিকা পরীক্ষায় তৎকালীন ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেন।

ফজলুল হক তার প্রখর স্মৃতিশক্তির কারণে শিক্ষকদের খুবই স্নেহভাজন ছিলো। প্রবেশিকা পাশ করার পর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যে তিনি কলকাতায় গমন করেন।

১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। সে সময় প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।

নিজের মেধার বলে তিনি প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এফ.এ. পাশ করার পর তিনি গণিত, রসায়ন ও পদার্থ-বিদ্যায় অনার্সসহ একই কলেজে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। ১৮৯৩ সালে তিনি ৩টি বিষয়ে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণিতে বি.এ. পাশ করেন।

বি.এ. পাশ করার পর এম.এ. ক্লাসে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি ভাষায়। পরীক্ষার মাত্র ছয় মাস আগে তাকে এক বন্ধু ব্যঙ্গ করে বলে ছিলেন যে, মুসলমান ছাত্ররা অঙ্ক নিয়ে পড়ে না, কারণ তারা মেধাবী নয়।

এই কথা শুনে এ. কে. ফজলুল হকের জেদ চড়া হয়ে যায়। তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, অঙ্কশাস্ত্রেই পরীক্ষা দেবেন। এরপর, মাত্র ৬ মাস অঙ্ক পড়েই তিনি ১ম শ্রেণি লাভ করেন।

খেলাধুলার প্রতি ফজলুল হক খুবই আগ্রহী ছিলো। তিনি ১ম জীবনে নিজে বিভিন্ন খেলাধুলার সাথে জড়িত ছিলেন এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলো।

তিনি মোহামেডান ফুটবল ক্লাবের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এর সাথে জড়িত ছিলেন। এছাড়া তিনি দাবা, সাঁতার সহ বিভিন্ন খেলা পছন্দ করতেন।

আড়ো পড়ুন: কাজী নজরুল ইসলাম জীবনী
আড়ো পড়ুন: হুমায়ূন আহমেদ আত্মজীবনী

পরিবার ও পরিজন:

এ. কে. ফজলুল হকের পূর্বপুরুষ ১৮শতকে ভারতের ভাগলপুর হতে পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার বিলবিলাস গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।

এ বংশের কাজী মুর্তজা একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের ব্যক্তি ছিলেন। তার পুত্র কাজী মুহম্মদ আমিন। কাজী মুহম্মদ আমিনের পুত্র মুহম্মদ আকরাম আলী বরিশাল কোর্টে আইন পেশা করতেন।

তার ২ পুত্র কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ, কাজী আবদুল কাদের ও ৫কন্যা। কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদের একমাত্র পুত্র ছিলো এ. কে. ফজলুল হক।

কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ ১৮৪৩ সালে চাখারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ালেখা করেন।

বাংলার মুসলমানদের মধ্যে তিনি ৬ষ্ঠ গ্রাজুয়েট ছিলেন। ১৮৭১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি বি. এল. পাশ করে আইন পেশা শুরু করেন।

মুহম্মদ ওয়াজেদ রাজাপুর থানার সাতুরিয়া মিয়া বাড়ির আহমদ আলী মিয়ার কন্যা বেগম সৈয়দুন্নেছাকে (শেরে বাংলার মা) বিয়ে করেন।

মুহম্মদ ওয়াজেদ ১৯০১ সালের ৯ফেব্রুয়ারি বরিশালে মৃত্যুবরণ করেন।

এ. কে. ফজলুল হক এম.এ. পাশ করার পর দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করে ছিলেন। এ সময় নবাব আবদুল লতিফ সি. আই. ই.-এর পৌত্রী খুরশিদ তালাত বেগমের সাথে তার বিয়ে হয়।

খুরশিদ তালাত বেগম ২টি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। খুরশিদ তালাত বেগমের অকাল মৃত্যুর পর তিনি হুগলী জেলার অধিবাসী এবং কলকাতা অবস্থানকারী ইবনে আহমদের কন্যা জিনাতুন্নেসা বেগমকে বিয়ে করেন।

কিন্তু, জিনাতুন্নেসাও নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোক গমন করেন এবং ১৯৪৩ সালে এ. কে. ফজলুল হক মীরাটের এক ভদ্র মহিলাকে পত্নীত্বে বরণ করে ছিলেন।

তাদের সন্তান এ. কে. ফাইজুল হক ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পাট প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ২০০৭ সালে মারা যান।

কর্মজীবন:

১৮৯৭ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বি.এল. পাশ করেন স্যার আশুতোষ মুখার্জির শিক্ষানবিশ হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করে এ. কে. ফজলুল হক।

২বছর শিখানবিশ হিসেবে কাজ করার পর ১৯০০ সালে তিনি সরাসরি আইন পেশাই শুরু করেন।

পিতার মৃত্যুর পর ১৯০১ সালে তিনি বরিশালে ফিরে আসেন এবং বরিশাল আদালতে যোগদান করেন।

১৯০৩ – ১৯০৪ সালে বরিশাল বার এসোসিয়েশনের সহকারী সম্পাদক পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে ছিরেন।

এ সময়ই তিনি বরিশাল রাজচন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর হরেন্দ্রনাথ মুখার্জির অনুরোধে ঐ কলেজে অঙ্কশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

১৯০৬ সালে আইন পেশা ছেড়ে এ কে ফজলুল হক সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন।

পূর্ব-বাংলার গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার তাকে ডেকে সম্মানের সাথে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেন।

সরকারি চাকুরিতে তিনি কিছুদিন ঢাকা ও ময়মনসিংহে কাজ করেন। এরপর তাকে জামালপুর মহকুমার এস.ডি.ও হিসেবে নিযুক্ত করে ছিলেন।

বঙ্গভঙ্গ কে কেন্দ্র করে জামালপুরে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা শুরু হয়। ফজলুল হকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সেখানে দাঙ্গা বন্ধ করেন।

জামালপুর মহকুমাতে চাকরি করার সময় তিনি জমিদার ও মহাজনের যে নির্মম অত্যাচার নিজের চোখে দেখেন এবং এর প্রতিকার করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়,

পরবর্তী জীবনে তা তার জন্য খুবই সহায়ক হয়ে ছিলো।

১৯০৮ সালে এস.ডি.ও –এর পদ ছেড়ে দিয়ে তিনি সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার পদ গ্রহণ করেন।

এ সময় তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক শ্রমিকদের বাস্তব অবস্থা নিজের চোখে পর্যবেক্ষণ করেন।

সরকারের সাঙ্গে বনিবনা না হওয়ার করনে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি চাকুরি ছেড়ে দেয়।

সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯১১ সালে এ. কে. ফজলুক হক কলকাতা হাইকোর্টে যোগদান করেন।

কলকাতায় তাকে সেদিন নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয়। সংবর্ধনা সভার সভাপতিত্ব করেন নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ।

সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি:

শিল্প সাহিত্যের সাঙ্গে এ. কে. ফজলুল হকের সান্নিধ্য ঘটে বরিশালে। কিশোর কিশোরীদের জন্য এ সময় তিনি নিজের সম্পাদনায় বালক নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে ছিলেন।

এর কিছুদিন পর তিনি ভারত সুহৃদ নামে যুগ্ম সম্পাদনায় আরো একটি সাপ্তাহিক প্রত্রিকা প্রকাশ করে ছিলেন।

এ সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত নবযুগ নামক পত্রিকার সম্পাদক ছিলো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

প্রখ্যাত বামপন্থি রাজনীতিবিদ কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের প্রস্তাবে এ. কে. ফজলুক হক নবযুগের প্রকাশনাতে সাহায্য করতে সমর্থ হয়ে ছিলেন।

নজরুলের বিদ্রোহী লেখার কারণে নবযুগ হু হু করে বিক্রি হয়ে গেল।

কলকাতা উচ্চ আদালতের ইংরেজ বিচারপতি টিউনন ফজলুল হক সাহেবকে নিজের খাস কামরায় ডেকে নিয়ে ব্রিটিশ সরকার বিরোধী লেখার জন্য হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়।

কিন্তু ফজলুল হক ভয় না পেয়ে ও টিউননের কাছ থেকে ফিরেই নজরুলকে খবর দিয়ে বললেন, “আরো গরম লিখে যাও, ইংরেজ সাহেবদের টনক নাড়িয়ে দাও”।

[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] নজরুলের লেখা চলতে থাকলে এক সময় ব্রিটিশ সরকার নবযুগ পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করে দেয়া হবে এবং কাগজটি বন্ধ করে দেয়া হয়।

হক সাহেবের চেষ্টায় আবার নবযুগ চালু হলেও, তিক্ত বিরক্ত নজরুল নবযুগের কাজ ছেড়ে দেয়। এ.কে. ফজলুল হক রচিত গ্রন্থের নাম বেঙ্গল টুডে। ব্রিটিশ আমলে রাজনীতি।

বরিশাল পৌরসভা নির্বাচন:

আড়ো পড়ুন: কাজী নজরুল ইসলাম জীবনী
আড়ো পড়ুন: হুমায়ূন আহমেদ আত্মজীবনী

বরিশাল পৌরসভার চেয়ারম্যান অশ্বিনীকুমার দত্ত এ. কে. ফজলুল হককে কমিশনার পদে প্রার্থী হবার আহবান জানান।

এ. কে. ফজলুক হক পৌরসভা ও জেলা বোর্ডের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্ব্ব্বিতা করেন এবং বিপুল ভোটের ব্যবধানে সদস্য নির্বাচিত হন। এর মাধ্যমেই এ. কে. ফজলুক হকের রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত।

বঙ্গীয় আইন পরিষদ:

১৯১৩ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে এ. কে. ফজলুলহক বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯১৫ সালে পুনরায় ঢাকা বিভাগ থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ছিলেন।

১৯১৩ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ পরিষদের সভায় মোট ১৪৮ বার বক্তৃতা করেন।

১৪৮ বার বক্তৃতার ভেতর ১২৮ বার তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন মুসলমানদের শিক্ষা সম্পর্কে বক্তৃতা দেয়ার জন্য।

তার অদম্য চেষ্টার ফলে ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ব-বিদ্যালয় এলাকায় কারমাইকেল ও টেইলার হোস্টেল স্থাপন করা হয়ে ছিলো।

তৎকালীন শিক্ষা বিভাগের ডি.পি.আই কর্ণেল সাহেব তখন ফজলুল হকের শিক্ষা বিষয়ক উদ্যোগের প্রশংসা করে তাকে বাংলার “বেন্থাম” হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

নিখিল ভারত মুসলিম লীগ:

১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্সে অংশ গ্রহণ করেন ফজলুল হক।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে বাংলার জনগণ বিভক্ত হয়ে পড়লে, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ উপলব্ধি করেন মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি সংগঠন তৈরী করা দরকার।

এই চিন্তা থেকেই ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স আহবান করে ছিলেন।

এই সম্মেলনে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ নিজে এবং যুগ্ম সচিব হিসেবে দায়িত্ব লাভ করে ছিলেন নবাব ভিকারুল মুলক এবং আবুল কাশেম ফজলুল হক।

সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়ে ছিলো পুরান ঢাকার আহসান মঞ্জিলে।

এই কনফারেন্সে নবাব সলিমুল্লাহ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নামে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন ও সেই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

অবশেষে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের সূত্রপাত ঘটে।

১৯১২ সালে এ. কে. ফজলুক হক মুসলিম লীগে যোগদান করেন।

কিন্তু এই সংগঠনের সাঙ্গে সাংগঠনিক নানা বিষয়ে তার বিরোধ বাধে।

১৯১৪ সালের ঢাকার আহসান-উল্লাহ-ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল বর্তমানে বুয়েট প্রাঙ্গণে মুসলিম লীগের প্রাদেশিক বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে ছিলো।

এ সম্মেলনে এ. কে. ফজলুক হক প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন।

তিনি ১৯১৮ সালে দিল্লীতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

বাঙালিদের মধ্যে তিনিই একমাত্র নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯১৯ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট পদ লাভ করে থ্কেন।

নিখিল ভারত কংগ্রেস:

১৯১৪ সালে ফজলুল হক নিখিল ভারত কংগ্রেস দলে যোগদান করেন।

একই সাথে তিনি মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস দলের নেতা হয়ে উঠেন।

১৯১৮ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হয়ে ছিলেন।

খেলাফত আন্দোলন:

আড়ো পড়ুন: কাজী নজরুল ইসলাম জীবনী
আড়ো পড়ুন: হুমায়ূন আহমেদ আত্মজীবনী

এ. কে. ফজলুক হক খেলাফত আন্দোলনেও অংশ গ্রহণ করেন।

প্রথম বিশ্ব-যুদ্ধের পর খেলাফত আন্দোলনের সূত্র-পাত ঘটায়।

এ. কে. ফজলুক হক নিখিল ভারত খেলাফত কমিটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

বাংলার শিক্ষামন্ত্রী:

১৯২২ সালে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে এ. কে. ফজলুক হক খুলনা উপ-নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং তিনি নির্বাচিত হন।

১৯২৪ সালে খুলনা অঞ্চল থকে পুনরায় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ছিলেন এবং এ সময় বাংলার গভর্নর ছিলো লিটন, তিনি ফজলুল হককে বাংলার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়োগ করেন।

১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহেরু-এর নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল স্বরাজ্যদল।

এই দলের অন্যতম কর্মসূচি ছিল আইনসভায় নির্বাচিত হয়ে সরকারি নীতির বিরোধিতা সহ সরকারি বাজেট বা আয় ব্যয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়।

স্বরাজ্য পার্টি ১৯২৪ সালের বাজেটের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে।

এ সময় ১৯২৪ সালের ১ আগস্ট এ. কে. ফজলুক হক মন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন।

র‌্যামজে ম্যাকডোনাল্ডের গোলটেবিল বৈঠক:

ভারতের ভবিষ্যত শাসন-তন্ত্রের রূপ-রেখা নির্ধারণের লক্ষ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার র‌্যামজে ম্যাকডোনাল্ড (James Ramsay MacDonald ) একটি গোল-টেবিল বৈঠক আহবান করা হয়।

কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মহাত্মা গান্ধী এই বৈঠক প্রত্যাখান করেন।

কিন্তু, মুসলিম লীগ সেই বৈঠকে অংশ-গ্রহণ করে। ১৯৩০ – ১৯৩১ সালের প্রথম গোল-টেবিল বৈঠকে ফজলুল হক বাংলা এবং পাঞ্জাবের মুসলমানদের জন্যে সংখ্যা-গরিষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব দাবি করে ছিলেন।

তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচনের পক্ষে বক্তৃতা দেন। ১৯৩১- ১৯৩২ সালে দ্বিতীয় গোল-টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

এই বৈঠকে কংগ্রেসও যোগ দেয়। এ বৈঠকেও সাম্প্রদায়িক প্রশ্নের সমাধান না হওয়ায় ভারতের শাসনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব চলে যায় ব্রিটিশের হাতে।

কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচন:

১৯৩৫ সালে এ. কে. ফজলুক হক কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। তিনিই কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের প্রথম মুসলিম মেয়র।

কৃষক রাজনীতি:

১৯২৪ সালে শিক্ষা-মন্ত্রীর পদে ইস্তফা দেওয়ার পর থেকে আবুল কাশেম ফজলুল হক সম্পূর্ণরূপে জড়িয়ে পড়ে ছিলেন কৃষকদের রাজনীতি নিয়ে।

১৯২৯ সালের ৪ জুলাই বঙ্গীয় আইন পরিষদের ২৫ জন মুসলিম সদস্য কলকাতায় একটি সম্মেলনে মিলিত হয়ে ছিলেন।

এই সম্মেলনে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি নামে একটি দল গঠনের সিদ্ধান্ত করা হয়। বাংলার কৃষকদের উন্নতি সাধনই ছিলো এই সমিতির অন্যতম লক্ষ্য।

১৯২৯ সালেই নিখিল বঙ্গ প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়। ঢাকায় প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৪ সালে।

এই সম্মেলনে এ. কে. ফজলুক হক সর্বসম্মতি-ক্রমে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়।

ময়মনসিংহে বঙ্গীয় প্রজা সমিতির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৫ সালে।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত সঙ্গীত এবং মরমী শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের গানের মধ্যে দিয়ে এ সম্মেলন শুরু হয়ে ছিলো।

এই প্রজা সমিতির মধ্য দিয়েই পরবর্তীকালে কৃষক-প্রজা পার্টির সূত্রপাত ঘটে।

১৯৩৭–এর নির্বাচন:

আড়ো পড়ুন: কাজী নজরুল ইসলাম জীবনী
আড়ো পড়ুন: হুমায়ূন আহমেদ আত্মজীবনী

১৯৩৭ সালের মার্চে বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টির পক্ষ থেকে পটুয়াখালী নির্বাচনী এলাকা থেকে এ. কে. ফজলুল হক ও মুসলিম লীগের মনোনীত পটুয়াখালীর জমিদার ও ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য খাজা নাজিমুদ্দিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

মুসলিম লীগের প্রার্থী খাজা নাজিমুদ্দিনের নির্বাচনী প্রতীক ছিলো “হারিকেন” আর হক সাহেবের কৃষক প্রজা পার্টির প্রতীক ছিলো “লাঙ্গল”।

কৃষক প্রজা পার্টির শ্লোগান ছিলো, “লাঙল যার জমি তার, ঘাম যার দাম তার”। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

পটুয়াখালীতে এ. কে. ফজলুল হক ১৩,০০০ ভোট পেয়ে ছিলো। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

অপর দিকে, খাজা নাজিমুদ্দিন ৫,০০০ হাজার ভোট পেয়ে ৭,০০০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়।

এই নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টি ৩৯টি আসন ও মুসলিম লীগে ৩৮ টি আসন লাভ করে।[১৩]

নির্বাচনে মুসলিম লীগের সাঙ্গে সমঝোতায় গিয়ে এ. কে. ফজলুক হক ১১ সদস্য বিশিষ্ট যুক্ত মন্ত্রি-পরিষদ গঠন করেন।

মন্ত্রীদের মধ্যে ৩জন কৃষক প্রজা পার্টির, ৩জন মুসলিম লীগের, ৩জন বর্ণ হিন্দুর এবং ২জন তফসিলি সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল এ. কে. ফজলুক হকের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রী পরিষদ গভর্নর এন্ডারসনের কাছে শপথ গ্রহণ করেন।

আইন পরিষদের স্পিকার ছিলো স্যার আজিজুল হক ও ডেপুটি স্পিকার হলো জালালউদ্দিন হাশমী।

বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক।

বাংলার প্রধানমন্ত্রী:

তিনি ছিলো অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ. কে. ফজলুক হক বহু কর্মসূচি হাতে নিয়ে ছিলো।

শিক্ষা ক্ষেত্রেই জোর দিয়ে ছিলো বেশি। তার আমলে দরিদ্র কৃষকের উপরে কর ধার্য না করে সারা বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়।

‘বিনা ক্ষতি-পূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ’-এর পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করে। তিনি এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৮ সালে ‘ফ্লাউড কমিশন’ গঠন করে।

১৯৩৮ সালের ১৮ আগস্ট বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনী পাস করা হয় এবং জমিদারদের লাগামহীন অত্যাচার চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়।

১৯৩৯ সালের “বঙ্গীয় চাকুরি নিয়োগবিধি” প্রবর্তন করে মন্ত্রী পরিষদ মুসলমানদের জন্য শতকরা ৫০ ভাগ চাকুরি নির্দিষ্ট রাখার ব্যবস্থা করে।

এ বছরেই ‘চাষী খাতক আইন’ এর সংশোধনী এনে ঋণ সালিশি বোর্ডকে শক্তিশালী করা হয়।

ক্লাউড কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ১৯৪০ সালে হক সাহেব আইন পরিষদের “মহাজনী আইন” পাস করেন।

এ বছরই ‘দোকান কর্মচারী আইন’ প্রণয়ন করে তিনি দোকান শ্রমিকদের সপ্তাহে ১দিন বন্ধ ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানের নির্দেশ জারি করেন।

কৃষি আধুনিকায়নের জন্য ঢাকা, রাজশাহী এবং খুলনার দৌলতপুরে কৃষি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়ে থাকেন।

পাটচাষীদের নায্য মূল্য পাওয়ার লক্ষ্যে ১৯৩৮ সালে “পাট অধ্যাদেশ” জারি করা হয়। ১৯৪১ সালের ১২ ডিসেম্বর আবুল কাশেম ফজলুল হক দ্বিতীয়বারের মত মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন।

শরৎচন্দ্র বসু ও হিন্দু মহাসভার সহ-সভাপতি শ্যামা-প্রসাদ মুখার্জির সঙ্গে প্রগতি-শীল যুক্ত পার্টি গঠন করেন তিনি সেই দলের নেতা হয়ে ছিলো।

১৭ ডিসেম্বর এই মন্ত্রী পরিষদ বাংলার গভর্নর জেনারেল হার্বাটের কাছে শপথ গ্রহণ করেন।[১৪]

লাহোর প্রস্তাব:

আড়ো পড়ুন: কাজী নজরুল ইসলাম জীবনী
আড়ো পড়ুন: হুমায়ূন আহমেদ আত্মজীবনী

নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের ওয়ার্কিং কমিটির অন্যান্য সদস্য সহ এ. কে. ফজলুল হক (পাশে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ)

১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের পক্ষ হতে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের প্রারম্ভিক খসড়া তৈরি করেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী সিকান্দার হায়াত খান এবং প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন এ. কে. ফজলুল হক।

ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব হচ্ছে ভারতীয় উপ-মহাদেশে বসবাসকারী মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি জানিয়ে উত্থাপিত প্রস্তাবনা।

পাঞ্জাবের মুখ্য-মন্ত্রী সিকান্দার হায়াত খান লাহোর প্রস্তাবের প্রারম্ভিক খসড়া তৈরি করেন, যা আলোচনা ও সংশোধনের জন্য নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাবজেক্ট কমিটি সমীপে পেশ করা হয়ে থাকে।

সাবজেক্ট কমিটি এ প্রস্তাবটিতে আমূল সংশোধন আনয়নের পর ২৩ মার্চ সাধারণ অধিবেশনে মুসলিম লীগের পক্ষ হতে ফজলুল হক সেটি উপস্থাপন করেন এবং চৌধুরী খালিকুজ্জামান ও অন্যান্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ তা সমর্থন করেন। এই লাহোর প্রস্তাবই “পাকিস্তান প্রস্তাব” হিসেবে পরবর্তী কালে আখ্যায়িত হয়।

মুসলিম লীগে যোগদান:

১৯৪৬ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে বরিশাল অঞ্চল ও খুলনার বাগেরহাট অঞ্চল থেকে প্রার্থী হয়ে তিনি নির্বাচিত হন।

কিন্তু, দলীয় ভাবে পরাজিত হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা গঠন করেন ও বাংলার মুখ্য-মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

এই নির্বাচনের পর দলীয় নেতাকর্মীদের চাপে হক সাহেব মুসলিম লীগে যোগদান করে। কিন্তু দলের সদস্য হিসেবে তিনি ছিলেন নীরব।

পাকিস্তান আমলে রাজনীতি:

পাকিস্তান গঠিত হবার পর থেকে হক সাহেব ঢাকা হাইকোর্টে পুনরায় আইন পেশা শুরু করে ছিলেন।

তিনি ঢাকা হাইকোর্ট বারের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন।

১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলো। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে এ. কে. ফজলুল হক সমর্থন দেন।

কৃষক শ্রমিক পার্টি গঠন:

মূল নিবন্ধ: কৃষক শ্রমিক পার্টি: ১৯৫৩ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় তার বাস ভবনে কৃষক-প্রজা পার্টির কর্মীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

এই সম্মেলনে দলের নাম থেকে প্রজা শব্দটি বাদ দিয়ে ‘কৃষক শ্রমিক পার্টি’ গঠন করা হয়ে থাকে।

আবদুল লতিফ বিশ্বাসকে সাধারণ সম্পাদক করে এই পার্টির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এ. কে. ফজলুক হক।

যুক্তফ্রন্ট গঠন:

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠিত পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভা: ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর এ. কে. ফজলুক হক,

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে গঠিত হল যুক্তফ্রন্ট।

যুক্তফ্রন্টের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করার জন্য এ সময়ে সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’কে দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তর করা হয়। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠা সম্পাদক। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

এই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ নয়টি আসন লাভ করে। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

১৯৫৪ সালের তিন এপ্রিল এ. কে. ফজলুক হক চার সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রি-সভা গঠন করেন।

পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী পরিষদ গঠন করা হয় ১৫মে।

মুখ্য-মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেরে-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক।

পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্য-মন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক:

যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি ছিল। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিপরিষদ এই ২১ দফা বাস্তবায়নের জন্য তৎপর হন।

তাদের গৃহীত উল্লেখ্য-যোগ্য কর্মসূচি গুলো হলো:

বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ।

২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা।

ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিতে ‘শহীদ মিনার’ নির্মাণ।

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষা গবেষণা কেন্দ্র বা বাংলা একাডেমি ঘোষণা করা।

জমিদারি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেওয়া।

এ সময় এ. কে. ফজলুক হক কলকাতা সফরে যান।

১৯৫৪ সালের ৩১ মে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী পরিষদ বাতিল করে দিয়ে ৯২ (ক) ধারা জারির মাধ্যমে প্রদেশে গভর্নরের শাসন প্রবর্তন করেন।

১৯৫৫-এর নির্বাচন:

আড়ো পড়ুন: কাজী নজরুল ইসলাম জীবনী
আড়ো পড়ুন: হুমায়ূন আহমেদ আত্মজীবনী

১৯৫৫ এর ৫ জুন সংখ্যাসাম্যের ভিত্তিতে পুনরায় গণ-পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়।

মুসলিম লীগের চৌধুরী মোহাম্মদ আলী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। এ. কে. ফজলুল হক ছিলো এই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলো বিরোধী দলের নেতা।

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর:

১৯৫৬ এর ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গৃহীত ও ২৩ মার্চ তা কার্যকরী হয়।

এ সময় এ. কে. ফজলুল হক পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র-মন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে ৮৩ বছর বয়সে করাচি থেকে ঢাকা এসে ১৯৫৬ সালের ২৪ মার্চ পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে।

১৯৫৮ সালের ১ এপ্রিল পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার তাকে গভর্নরের পদ থেকে অপসারণ করেন।

এরপরই তিনি তার ৮৬ বছরের বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক জীবন থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।

অবসরে এ. কে. ফজলুল হক:

১৯৫৮ এর ২৭ অক্টোবর আবুল কাশেম ফজলুল হককে পাকিস্তানের ২য় সর্বোচ্চ পদক “হেলাল-ই-পাকিস্তান” খেতাব দেয়া হয়।

১৯৬১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ব-বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ তাকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে এবং তাকে হলের আজীবন সদস্য পদ প্রদান করা হয়।

এই সংবর্ধনা সভার পর তিনি আর কোন জনসভায় যোগদান করেননি। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

১৯৬২ এর ২৭ মার্চ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

তিনি প্রায় ১মাস চিকিৎসাধীন আবস্থায় ছিলেন।

মৃত্যু:

সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে অবস্থিত তিন নেতার মাজারে শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের কবর।

১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ১০ টা ২০ মিনিটে এ. কে. ফজলুক হক ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন।

২৮ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তার মরদেহ ঢাকার টিকাটুলি এলাকায় তার ২৭ কে. এম. দাস লেনের বাসায় রাখা হয়।

সেদিন সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে ঢাকার পল্টন ময়দানে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাকে সমাহিত করা হয়।

একই স্থানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিনের কবর দেয়া হয়েছে।

তাদের ৩জনের সমাধিস্থলই ঐতিহাসিক ৩নেতার মাজার নামে পরিচিত। [১৮]

রেডিও পাকিস্তান সেদিন সব অনুষ্ঠান বন্ধ করে সারাদিন কোরআন পাঠ করে।

জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখে তার প্রতি সম্মান দেখানো হয়।

৩০ এপ্রিল সোমবার পাকিস্তানের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্কুল কলেজে ছুটি ঘোষণা করা হয়।

সম্মাননা:

আড়ো পড়ুন: কাজী নজরুল ইসলাম জীবনী
আড়ো পড়ুন: হুমায়ূন আহমেদ আত্মজীবনী

ঢাকা বিশ্ব-বিদ্যালয়ে তার নামে একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছে। [১৯]

রাজশাহী বিশ্ব-বিদ্যালয়ের আবাসিক হল জিন্নাহ হলের নাম পরিবর্তন করে তার নামে করা হয়ে।

কুয়েটে তার নামে একটি ছাত্র আবাসিক হল (ফজলুল হক হল) আছে।

বুয়েটেও তার নামে একটি আবাসিক হলের (শেরে বাংলা হল) নামকরণ করা হয়েছে।[২০]

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ব-বিদ্যালয়ে তার নামে একটি হলের নামকরণ করা হয়েছে।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব-বিদ্যালয়ে তাঁর নামে একটি ছাত্র আবাসিক হল রয়েছে।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তার নামে একটি কৃষি বিশ্ব-বিদ্যালয় রয়েছে, শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ব-বিদ্যালয়,

[২১] যা ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তৎকালীন পাক-ভারত উপ-মহাদেশে প্রথম কৃষি শিক্ষা-বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ছিলো।

শেরে-বাংলা এ কে ফজলুল হক নিজেই এর ভিত্তি-প্রস্তর স্থাপন করেন।

আড়ো পড়ুন: কাজী নজরুল ইসলাম জীবনী
আড়ো পড়ুন: হুমায়ূন আহমেদ আত্মজীবনী

এছাড়া এই শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ব-বিদ্যালয়ে তার নামে একটি হল ও রয়েছে।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তার নামে একটি এলাকার নামকরন করা হয়েছে শের-এ-বাংলা নগর (পূর্ববর্তী আইয়ুব নগর ও তারও পূর্বে মনিপুর),

যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ অবস্থিত।

বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট মাঠ শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম, মিরপুর, ঢাকা। যা বাংলাদেশের হোম অব ক্রিকেট হিসেবে খ্যাত।

বরিশালে তার নামে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের নামকরণ করা হয়েছে।

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দক্ষিণবঙ্গের ৫ চিকিৎসা-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল।

যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে।

Leave a Comment