বিদ্রুপে বিদ্রোহের আগুন: মুক্তিযুদ্ধ প্রায় শেষ পর্যায়ে, নভেম্বর মাস। নীপাদের বাড়ি ছিল মঠবাড়িয়ার দধিভাঙা বাজারে।
সে তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তার বড় চার ভাইবোন। দুই বোন ও দুই ভাই। অনেক দু:সহ স্মৃতি বয়ে নিয়ে, নৌকা করে কোলকাতা চলে যায়।
এদিকে যুদ্ধ যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য নীপাকে নিয়ে তার বাবা কোলকাতা রওনা হয়।
পথে নীপাকে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় মিত্রবাহিনী ও বিএসএফ এর তল্লাশি এবং তাদের নানা প্রশ্নে জর্জরিত হতে হয়েছে।
এক পর্যায়ে সকল বাধা ও সীমান্তের বিপত্তি পেরিয়ে যখন তারা কোলকাতায় প্রবেশ করে, তখন তাদের আর এক অভিনব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
আরো পড়ুন: ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের সুরক্ষা মিলবে কালোজিরায়
আরো পড়ুন: পর্নোগ্রাফি আইন সম্পর্কে আলোচনা ও বিচার
তাড়াহুড়ো করে চলে আসায়, তারা কোলকাতার যেখানে যাবে, ভাইবোনদের থাকার সেই ঠিকানাই নিয়ে আসেনি।
যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে যাতায়াতের বিড়ম্বনা আর সন্তানদের সাথে দেখা করার তীব্র বাসনার অদম্য উচ্ছাস সব মিলিয়ে এক পর্যায়ে নীপার বাবার এমন ভুলটি হয়েছে।
কিন্তু কোলকাতার মত জায়গায় ঠিকানা নিয়ে না এসে যে কি, বিশাল বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে তা সবাই আমরা অনুভব করতে পারি।
এরই প্রেক্ষাপটে, এক পর্যায়ে নীপার বাবা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন এবং হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকেন।
তখন হঠাৎই বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা পরিচিত এক শরণার্থী পরিবারের সাথে দেখা হয়ে যায়-শিয়ালদার রেল লাইনের পাশে পরিবার পরিজন নিয়ে একটি ঝুপড়ি ঘরের মধ্যে কোনরকমে বৌ-বাচ্চা নিয়ে বসবাস করে অসম্ভব দৈণ্যদশা তাদের!
বিদ্রুপে বিদ্রোহের আগুন
কিন্তু সেদিনের সে দুর্দিনে উপায়ন্ত না দেখে তারা দু’জনে তখন সেই পরিবারের কাছেই আশ্রয় নেন।
এরপর নীপাকে রেল লাইনের সেই বস্তিতে রেখে তার বাবা অন্য সন্তানদের ঠিকানার সন্ধানে কোলকাতা শহরময় চষে বেড়ান।
এভাবে তিনদিন ঘোরাঘুরির পর ভাগ্যক্রমে কোলকাতার চেতলা অঞ্চলে এক নিকটতম আত্মীয়ের সন্ধান মিলে যায়।
আর সেখান থেকেই নীপার বাবা তার ভাইবোনদের ঠিকানা খুঁজে পান। এদিকে নীপা এই তিনদিন বস্তির সেই বাড়িতে থেকে নানা কষ্টকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়।
যে কষ্টকর পরিবেশে নীপা কোনদিনই অভ্যস্ত ছিল না। বিশেষ করে, তিনবেলা খাবার, টয়লেট সমস্যা, শোয়ার জায়গার অভাবে রাতজেগে থাকা এইসব!
কেননা, শরণার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত খাবার নীপাকেও তিনবেলা খেতে হতো। জীবন বাঁচাতে ঐ খাবার তার কাছে একমাত্র অবলম্বন ছিল।
যদিও এখন নীপা স্বাধীনতার আস্বাদনে সেইসব দিনের দু:সহ সমস্ত স্মৃতির কথা ভুলে গেছে।
কিন্তু শালগম সবজিতে শুধুমাত্র হলদু, লবণ দিয়ে সম্পূর্ণ তেলবিহীন তরকারি খাওয়ার বিস্বাদ তার স্মৃতিপটে আজও জ্বলজ্বল করছে।
তাই তো, ঐ শালগম রান্না খাবারের দৈণ্যতার সুখ বহন করে চলেছে নীপা। কিন্তু দু:খ হলেও বাস্তব সত্য!
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও সুস্বাদু করে রান্না করা তরকারি নীপা কোনভাবেই খেতে পারছে না।
তাই, এখনো বিস্বাদিত তরকারির সেই স্বাদ ভুলতে না পারায়, নীপা শালগমের তরকারি এখন আর কোনদিন খেতে আগ্রহবোধ করে না।
এরই মধ্যে ঠিকানা খুঁজে পাওয়ায়, নীপা ও তার বাবা কাঙ্খিত বড় ভাইবোনদের ঠিকানায় পিকনি গার্ডেন রোডের বাসায় পৌঁছে যায়।
সেখানে ভাইবোনদের সাথে দেখা হওয়ার আনন্দে নীপার সব কষ্ট চোখের জলে ভিজিয়ে এক অন্য আবেগ তৈরি হয়।
অন্য অনুভূতি অনুভবের আবেশ এনে দেয় নীপার মনে।
বিদ্রুপে বিদ্রোহের আগুন
কোলকাতায় তখন গড়িয়া রোডের এক মালিকের ফুটপাতের দোকানে- তার মেজভাই কাজ করত।
নীপা ও তার পিঠাপিঠি বড়বোন রীপার সাথে প্রতিদিন গড়িয়া রোডের সেই দোকানে ভাইয়ের জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে যেত।
পায়ে হেঁটে দু’বোন একসাথে সেখানে নিয়মিত যেতে থাকল।
প্রতিদিন খাবার নিয়ে আসা-যাওয়ার পথে দু’বোনকে এক অভিনব সমস্যায় পড়তে হয়।
সেটি হল, কোলকাতার স্থানীয় একটি পরিবারের একটি মেয়ে প্রতিদিন নীপা ও তার বোনকে উদ্দেশ্য করে ছড়া কেটে কেটে বাজে মন্তব্য করত।
মেয়েটি বলতো :
বাংলাদেশের লোক বড় বড় চোখ
আতপ চালের ভাত খেয়ে
ক্যাম্পে গিয়ে ঢোক্!”
নিত্যদিনের এই ভর্ৎসনা শুনে শুনে নীপার মন বিষিয়ে উঠতে থাকে।
এরপর সেদিনের সেই ছোট্ট নীপা একদিন বিদ্রুপের বিদ্রোহের আগুনে জ্বলে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
একদিন সে রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা ইটের টুকরো তুলে ঐ বাড়ির দোতলায় সেই মেয়েটির উদ্দেশ্যে ছুড়ে মারতে থাকে।
তখন একটি ইটের টুকরো সেই বাড়ির কাচে ঘেরা জানালায় গিয়ে পড়ে এবং জানালার কাচ ভেঙে যায়।
কাচ ভাঙার শব্দ শুনে ঐ বাড়ির সকলে বেরিয়ে এসে নীপা ও তার বনোকে ধরে ফেলে।
সাথেসাথে নীপা ও বোনকে গালিগালাজ ও মারধর করতে উদ্যত হয়। সেদিন সেখানে এমন এক উদ্ভূত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
বিদ্রুপে বিদ্রোহের আগুন
তখন ঐ এলাকার স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী একটি যুব সংগঠনের কিছু বড়ভাই এসে প্রথমে নীপা ও তার বোনকে নিরাপত্তা দেন।
এরপর উভয়ের কথা অত্যন্ত ধীরস্থির ভাবে শুনেন। যুব সংঘের সদস্যরা তখন নীপার তীব্র ক্ষোভের বহি:প্রকাশ, কান্না ও ক্রোধ দেখে বিস্মিত হন।
এক পর্যায়ে সমস্ত ঘটনা নীপার কাছে জানতে চাইলে, নীপার তীব্র ক্ষোভের বহি:প্রকাশ, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকা দেশপ্রেম দেখে, সেখানে সকলেই খুব আবেগপ্রবণ হয়ে যান।
সেদিন ছোট্ট নীপার দেশাত্মবোধের অনন্য উদাহরণ দেখে তারা আপ্লুত হন।
এসময় সকলে স্বদেশী আন্দোলন, ভারত ভাগ, মুক্তিযুদ্ধ এসব বিষয় আলোচনা করলে, তখন নীপা সবকিছু না বুঝলেও- মুক্তিযুদ্ধ ও দেশাত্মবোধ সম্পর্কে সচেতন ছিল।
আরো পড়ুন: চুল ঘন কালো ও মসৃণ করতে নিয়মিত ডিম ব্যবহার করুন
আরো পড়ুন: গ্রাফিক্স ডিজাইন করে আয় করার ১২ টি জনপ্রিয় উপায়
ফলে, সেদিন যুব সংগঠনের সদস্যরা নীপার দেশ ছেড়ে চলে আসা শরণার্থী জীবনের কষ্ট বুঝে, তখন তারা ঐ পরিবারের মেয়েটি প্রতিদিন যে, খারাপ ব্যবহার করত এবং সেদিন ওই পরিবারের সদস্যদের আচরণ কোনভাবেই ঠিক হয়নি বলে, যুব সংঘের সদস্যরা অভিমত প্রকাশ করেন।
একই সাথে উপস্থিত যুবকরা বলেন যে, তাদের দেশে আশ্রিত আর কোনও বাঙালিকে যেন এমন ঘটনার সম্মুখীন হতে না হয়।
এভাবে ওই পরিবারকে সতর্ক করে দেয়া হয়। নীপাকে আস্বস্ত করা হয় যে, আমারও বাঙালি, তোমরাও বাঙালি। তোমরা এদেশে আশ্রিত নও…।
তাই, নীপা আজও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে- এলাকায় এলাকায় বড় ভাইবোন ও অভিভাবক নিয়ে সংগঠন থাকা খুবই জরুরি।
লেখাপড়ার পাশাপাশি ঐ সংগঠনগুলো পাড়া-মহল্লায় নাগরিক-সুনাগরিক, মানুষকে প্রকৃত মানুষ ও মানবকে মানব সম্পদ তৈরি করতে অনন্য ভূমিকা পালন করে।
আর এখান থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়- দেশাত্মবোধ, দেশপ্রেম ও আলোকিত মানুষ।
যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে।