হাসান হাফিজুর রহমান এর সংক্ষিপ্ত জীবনী:
- জন্ম: ১৪ জুন ১৯৩২ ইসলামপুর, জামালপুর, বাংলাদেশ)
- মৃত্যু: ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল, রাশিয়া, মস্কো
- পেশা: কবি, সাংবাদিক, সমালোচক
- ভাষা: বাংলা,
- জাতীয়তা: বাংলাদেশী,
- নাগরিকত্ব: বাংলাদেশ,
- শিক্ষা: বিএ, এমএ (বাংলা ভাষা ও সাহিত্য)
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,
- ধরন: কাব্য, প্রবন্ধ, গল্প, ভ্রমণকাহিনী,
- উল্লেখযোগ্য রচনা: একুশে ফেব্রুয়ারী মুক্তিযুদ্ধের দলিল(সম্পাদনা)
- উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: বাংলা একাডেমি, একুশে পদক পুরস্কার
- সক্রিয় বছর: ১৯৩২ থেকে ১৯৮৩,
- দাম্পত্যসঙ্গী: সাঈদা হাসান,
- সন্তান: হাসান সাঈদ দিশা, এশা হাসান মুন্নী,
- আত্মীয়: আবদুর রহমান (বাবা), হাফিজা খাতুন (মা),
আড়ো পড়ুন: হুমায়ুন কবির এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
আড়ো পড়ুন: হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সংক্ষিপ্ত জীবনী
হাসান হাফিজুর রহমান ( ১৪ জুন ১৯৩২ – ১ এপ্রিল ১৯৮৩) বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি, সাংবাদিক ও সমালোচক ছিলেন। তার পূর্ব-পুরুষ জামালপুর জেলার অন্তর্গত কুলকান্দি গ্রামে বাস করতেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের দলিল সম্পাদনার জন্য বিখ্যাত।
প্রাথমিক জীবন:
হাসান হাফিজুর রহমান ১৯৩২ সালে ১৪ জুন জামালপুর জেলায় তাঁর নানা বাড়িতে জন্ম-গ্রহণ করেন। পৈতৃক বাড়ি ছিলো জামালপুর জেলার ইসলাম-পুর উপজেলার কুল-কান্দি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আবদুর রহমান ও মায়ের নাম হাফিজা খাতুন। ১৯৫৮ সালের ১৭ এপ্রিল হাসান হাফিজুর রহমান সাঈদা হাসানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। হাসান হাফিজুর রহমান ও সাঈদা হাসানের ১ম সন্তানের নাম হাসান সাঈদ দিশা। ২য় সন্তানের নাম এশা হাসান (মুন্নী)।
শিক্ষাজীবন:
১৯৩৮ সালে ঢাকার নবকুমার স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সরাসরি ৩য় শ্রেণিতে ভর্তি হয়। ১৯৩৯ সালে তাঁর বাবা বরিশালে বদলি হয়ে গেলে ৩বছর জামালপুরের সিংজানী হাই-স্কুলে পড়াশুনা করেন। তিনি ১৯৪২ সালে তাঁর বাবা ঢাকায় বদলি হয়ে এলে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে থাকেন এবং মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত এই স্কুলেই পড়াশুনা করেন।
১৯৪৬ সালে হাসান হাফিজুর রহমান ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ২য় বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন। এবং এ বছরই ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে মানবিক শাখায় ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে হাসান হাফিজুর রহমান ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক পাস করেন। এবং এ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে বি.এ. অনার্স শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ না করে ১৯৫১ সালে তিনি পাস কোর্স-এ বি.এ. পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ১৯১৪ সালে মাধ্যমিক পাস করার পর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে ছিলেন।
কিন্তু ডাক্তারি পড়া অসমাপ্ত রেখেই তিনি শিক্ষা বিভাগে চাকুরি নিয়ে ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস কোর্স-এ বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে। এবং এ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ১ম পর্ব এম.এ. শ্রেণিতে ভর্তি হন। চাকরি জীবনের পুরোটা সময় তিনি ঢাকা শহরেই অতিবাহিত করেন। তবে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত তিনি বরিশালে কর্মরত ছিলো।
চাকুরি ছাড়াও তাঁর আয়ের উৎস ছিলো গ্রামের ভূ-সম্পত্তি। হাসান হাফিজুর রহমান ছিলো পিতার ২য় স্ত্রীর ১ম সন্তান। ১ম স্ত্রী নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যাওয়ার পর আবদুর রহমান ২য় বার বিয়ে করেন এবং তাঁর ১ম সন্তান হাসান হাফিজুর রহমান জন্ম-গ্রহণ করেন। তাঁরা ছিলো ৭ভাই ও ৩বোন।
ভাই-বোনদের মধ্যে ৩জনের মৃত্যু হয় অপরিণত বয়সে। স্কুলে ভর্তি হবার আগে মাকে তিনি মুখে মুখে একটি ছড়া শুনাতেন ‘খেয়ে মোদের অন্নজল / হবে মোদের হাতির বল ‘।
কর্মজীবন:
হাসান হাফিজুর রহমানের পেশাজীবন খুব বৈচিত্র্যময় ছিল। সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় ১৯৫২ সালে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি একাধারে সওগাত (১৯৫৩), ইত্তেহাদ (১৯৫৫-৫৪) ও দৈনিক পাকিস্তান (১৯৬৫) এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলায় সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি নিযুক্ত হন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি ১৯৫৭-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। এছাড়াও তিনি ১৯৭৩ সালে মস্কোস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস কাউন্সিলর পদে দায়িত্ব পালন করেন।
সাহিত্য:
১৯৪৬ সালে তিনি যখন স্কুলছাত্র, তখন তাঁর ছোট গল্প ” অশ্রুভেজা পথ চলাতে ” প্রকাশিত হয় সওগাত পত্রিকায়। এর দু বছর পর সোনার বাংলায় তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অবদান রাখেন। একুশের চেতনার উপর ভিত্তি করে তার কবিতা অমর একুশে প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালেই। এটি সহ আরও কিছু লেখা একত্রিত করে ১৯৫৩ সালে তিনি তাঁর প্রথম বই একুশে ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করেন।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড:
হাসান হাফিজুর রহমান বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক কার্ম কান্ডে জড়িত ছিলো। তিনি ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়। সেই বছর তিনি নাট্য চক্রের সভাপতি হলেও এবং ২টি গুরুত্ব-পূর্ণ প্রবন্ধ রচনা করেন। সে গুলো হলো: কবিতার বিষয় বস্তু ও আধুনিক কবিতার লক্ষণ। ষাটের দশকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক বাংলার অক্ষর বদলে আরবি অক্ষরে রূপান্তরের ষড়যন্ত্র ও রেডিও টিভিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্ম প্রচারের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবিতে জোরালো আন্দোলনে অংশ গ্যহন করেন। হাসান হাফিজুর রহমান সাম্যবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলো। তিনি বাঙালি কৃষ্টি এবং সংস্কৃতিতে অবিচল আস্থাশীল ছিলো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশ গ্রহন করেন।
সাহিত্যকর্ম:
হাসান হাফিজুর রহমান বেশি পরিচিত তাঁর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ১৬ খণ্ডের দলিল পত্রের (১৯৮২-৮৩) সম্পাদনার জন্য। উল্লেখ-যোগ্য রচনার মধ্যে:
কাব্য:
বিমুখ প্রান্তর (১৯৬৩),
আর্ত শব্দাবলী (১৯৬৮),
আধুনিক কবি ও কবিতা (১৯৬৫),
মূল্যবোধের জন্যে (১৯৭০),
অন্তিম শরের মতো (১৯৬৮)
যখন উদ্যত সঙ্গীন (১৯৭২)
শোকার্ত তরবারী (১৯৮১)
প্রতিবিম্ব (১৯৭৬),
আরো দুটি মৃত্যু (১৯৭০)
ভবিতব্যের বাণিজ্য তরী (১৯৮৩) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
প্রবন্ধ:
আধুনিক কবি ও কবিতা (১৯৬৫),
মূল্যবোধের জন্য (১৯৭০),
সাহিত্য প্রসঙ্গ (১৯৭৩),
আলোকিত গহবর (১৯৭৭),
গল্প:
আরো দুটি মৃত্যু (১৯৭০),
ভ্রমণকাহিনী,
সীমান্ত শিবিরে,
বাংলা ভাষায় হোমারের ওডিসি অনুবাদও করেছেন তিনি।
পুরস্কার ও পদক:
পাকিস্তান লেখক সংঘ পুরস্কার (১৯৬৭),
আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭),
বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭১),
সুফি মোতাহার হোসেন স্মারক পুরস্কার (১৯৭৬),
অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১),
সওগাত সাহিত্য পুরস্কার ও নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৮২),
মরণোত্তর একুশে পদক (১৯৮৪),
এ দেশের সাহিত্য ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০০২ সালে দেশের “সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার” হিসাবে পরিচিত স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয় তাকে।
মৃত্যু:
হাসান হাফিজুর রহমান ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল মস্কো সেন্ট্রাল ক্লিনিকাল হসপিটালে মৃত্যুবরণ করেন।